আহসানুল্লাহ হলের স্মৃতি কথা ও হাজতবাস (তৃতীয় পর্ব)
আর্মির জিপে আমাদেরকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। খোলা মাঠ,
পাশে একটি অফিস কক্ষ। সেই অফিসকক্ষে ভিতরে আমাদেরকে এক লাইনে দাঁড় করানো হলো। আমিও জামাল বিশ্বাস পাশাপাশি দাড়ালাম। আমাদেরকে দেখার জন্য আশেপাশে থেকে আর্মি ড্রেস পরা, সিভিল ড্রেসের আর্মির আনাগোনা শুরু হল। সবার চোখে-মুখে এক ধরনের হিংস্রতা। কারণ তাদেরই এক কলিগ কে মারা হয়েছে নির্মমভাবে এয়ারপোর্টে কিছুক্ষণ আগে। ঐ
সময় বিমান বাহিনী ওই কক্ষটির ইনচার্জ ছিলেন একজন নন-কমিশন অফিসার, কাজেই আমরা অনেক রুক্ষ আচার আচরণের সম্মুখীন হলাম। কিছুক্ষণ পরে সিভিল ড্রেস পরা এক জোয়ান আসলো,যাকে ঢাকা এয়ারপোর্টে মারধর করা হয়েছিল। ইনচার্জ,
তাকে বলল, আমাদের মধ্য থেকে কারা তাকে মেরেছিল সেটা শনাক্ত করার জন্য!
সে একজন একজন করে প্রত্যেককে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলো। আমার সামনাসামনি এসে আমার দু চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো,
আমি এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেরাতে লাগলাম যেন কোনোভাবেই তার সাথে চোখাচোখি না হয়। কেন জানি মনে হয়েছিল,
ওর সাথে চোখাচোখি হলে বিপদ হবে। সে ছয়জনের মধ্যে তিনজন কে জনকে শনাক্ত করলো। এরমধ্যে জামাল বিশ্বাস পরে গেল। সে ভয়ংকরভাবে ভয় পেয়ে গেল,পরিস্থিতি ভয় পাওয়ার মতোই । জামাল ইনচার্জ এর নিকট গিয়ে বলতে লাগল, আমি বুয়েটের ছাত্র,
আমার বন্ধুকে সি অফ করতে এসেছিলাম মাত্র। মারপিটের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই। জওয়ানদের আনাগোনা, শোরগোলে পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ ছিল, চতুর্দিক থেকে ইনচার্জ এর উপর প্রচন্ড প্রেসার ছিল। তাই কে শোনে কার কথা!
প্রথমে তেজগাঁর মাস্তান সমীরকে কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হল। কিছুক্ষণ পর আমরা তার গগনবিদারী, প্রাণান্তকর মুহুমুহু চিৎকার শুনতে লাগলাম, আমাদের সবার শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল।
এরপর তেজগাঁর দ্বিতীয় জনকে নিয়ে গেল। আবার সেই প্রাণান্তকর চিৎকার।
পরে সমীর সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেছিল। —-
তাকে নিয়ে পাশের অন্ধকার মাঠের মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। ওইখানে ছিল কয়েকজন বিশালাকৃতির কমান্ডো টাইপ লোক, তাদের পরনে শুধু জাংগিয়া ছিল। তারা সমীরকে প্রচন্ডভাবে মারধর শুরু করেছিল।সমির বলল, সে সুযোগ পেলেই দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, এভাবে নিজেকে অনেকটা রক্ষা করতে পেরেছিল। তা না হলে হয়তো, জানে মারা পড়তো। তার দাঁত মুখ থেকে রক্ত পড়ছিল,ওই সময় আমরা তা দেখেছিলাম । সম্পূর্ণ পরিস্থিতি ছিল বীভৎস ও ভয়ঙ্কর, আমাদের কল্পনার অতীত।
তৃতীয় দফায় জামালের ডাক পড়লো। জামাল ভয়ংকরভাবে ভীত হয়ে পড়েছিল এবংইনচার্জ এর কাছে গিয়ে, এটা সেটা বলতে শুরু করল। হঠাৎ ই একটা
অলৌকিক ঘটনা ঘটলো। তখনকার দুর্ধর্ষ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবী ওই কক্ষে ঢুকলো। সে আসার সাথে সাথে পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেল।আমাদের মধ্যেও কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসলো।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবী আমাদের থেকে সমস্ত ঘটনা ধীরেসুস্থে শুনলো।তারপর আমাদের প্রত্যেককে সাদা কাগজ দিল। আমাদেরকে বলল, আমাদের এয়ারপোর্টে আসার কারণ বিস্তারিতভাবে লেখার জন্য।
কিছুক্ষণ পর,
তখন রাত প্রায় বারোটা বাজে,
জানলা দিয়ে দেখলাম একটি পুলিশের গাড়ি। কয়েকজন পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে আসলো।
পুলিশকে দেখে আমাদের জানে পানি আসলো,।ওই অনুভূতিটা এখনো মনের মধ্যে আছে। পুলিশ থেকে সবসময় সাত হাত দূরে থাকার চেষ্টা করেছি, তেমনটাই গুরুজনরা বলেছেন সব সময়। এখন সেই পুলিশকে তখন
পরম মিত্র মনে হচ্ছিল।
চলবে—